প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে হবিগঞ্জের ৩টি পৌরসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নৌকা ডুবিয়ে ৩টিতেই হ্যাটট্রিক বিজয় অর্জন করেছে বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী। এর মধ্যে জামানত হারিয়ে লজ্জাজনকভাবে হেরেছেন মাধবপুর পৌরসভার নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী শ্রীধাম দাশ গুপ্ত। এছাড়া নবীগঞ্জ পৌরসভার নৌকার প্রার্থী বর্তমান সরকারের একজন পূর্ণমন্ত্রীর জামাতাকে হারিয়ে বিজয় অর্জন করেছেন বিএনপির প্রার্থী ছাবির আহমদ চৌধুরী।
এর আগে গত ২৮ ডিসেম্বর প্রথম ধাপের শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে হারিয়ে বিজয় অর্জন করে বিএনপির প্রার্থী। প্রার্থী মনোনয়নে ভুল সিদ্ধান্ত, বিদ্রোহী প্রার্থী ও দলীয় কোন্দলের কারণেই জেলার পৌরসভাগুলোতে একের পর এক নৌকার ভরাডুবি ঘটছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
আগামী দুটি নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন দলীয় প্রার্থীরা কুপোকাত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন খোদ দলের ত্যাগী নেতারা।
গত ১৬ জানুয়ারি নবীগঞ্জ পৌর নির্বাচনে ছিল টানটান উত্তেজনা। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বন ও পরিবেশমন্ত্রীর জামাতা গোলাম রসুল রাহেল চৌধুরী। তার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন অনেক কেন্দ্রীয় নেতা। নির্বাচনের আগের রাতে অর্থ লেনদেনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী রাহেল চৌধুরীসহ ৭ জন আহত হন। ভাঙচুর করা হয় আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থীর গাড়ি। এ সময় শহরে ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করে। সংঘর্ষে গুরুতর আহত ৩ জনকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
এদের মধ্যে বিএনপি প্রার্থীর ভাই শফিক মিয়া পেটে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মক আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পৌর শহরে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের টহল জোরদার করা হয়। পরে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে পরদিন সকাল থেকে ভোটগ্রহণ চলে। সংঘর্ষের আশঙ্কায় দিনভর নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিলেন সাধারণ ভোটাররা। একাধিকবার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তিন স্তরের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় শেষ পর্যন্ত কোনো অঘটন ছাড়াই নির্বাচন সম্পন্ন হয়। ফলাফলে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত নবীগঞ্জে মন্ত্রীর জামাতা রাহেল চৌধুরী মাত্র ২৬৪ ভোটে পরাজিত হন। বিএনপি প্রার্থী ছাবির আহমদ চৌধুরী পান ৫ হাজার ৭৪৯ ভোট। আর আওয়ামী লীগ প্রার্থী গোলাম রসুল রাহেল চৌধুরী পান ৫ হাজার ৪৮৫ ভোট।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মনে করেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ের নেপথ্যে বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে ভোটের আগের রাতের সংঘর্ষের ঘটনা। সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে বিএনপি প্রার্থীর চাচাতো ভাই শফিক মিয়ার ভুঁড়ি বেরিয়ে যায়। আহত শফিকের রক্তাক্ত ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে। এছাড়া ভোটারদের কাছে মর্মান্তিক এ বিষয়টি উপস্থাপন করেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এতে অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে বিএনপি প্রার্থীকে ভোট দেন স্থানীয় নিরপেক্ষ ও দোদুল্যমান ভোটারদের একটি অংশ।
এছাড়া কতিপয় নেতার লাইভে উল্টাপাল্টা বক্তব্যও অনেকটা বিরক্তিতে ফেলে সাধারণ ভোটারদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী জানান, দলীয় অদৃশ্য গ্রুপিংয়ের কারণেও প্রকৃতপক্ষে আন্তরিকভাবে কাজ করেননি দলের একটি অংশ। এ পৌরসভায় অভিজ্ঞ প্রভাবশালী প্রার্থীকে বাদ দিয়ে মন্ত্রীর জামাতা হিসেবে নতুন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়ায় নাখোশ ছিল দলের একটি অংশ। দলীয় স্বার্থে প্রকাশ্যে তারা বিরোধিতা না করলেও বিরোধী প্রার্থীর সঙ্গে অনেকেরই ব্যক্তিগত সমঝোতা হয়। যার কারণে প্রকাশ্যে কাজ দেখালেও অনেকেই দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করেন। ফলে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত নবীগঞ্জ পৌরসভায় অল্প ভোটের ব্যবধানে নৌকার পরাজয় হয়।
অন্যদিকে মাধবপুর পৌরসভায় আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থীর চেয়ে প্রায় ৯ গুণ বেশি ভোটে জয়ী হন ধানের শীষের প্রার্থী। নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী হাবিবুর রহমান মানিক বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হন। দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে জামানত হারিয়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী শ্রীধাম দাশ গুপ্ত। নির্বাচনে মাধবপুরে বিএনপির হাবিবুর রহমান মানিক পান ৫ হাজার ৩১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী পঙ্কজ কুমার সাহা পান ৪ হাজার ১৮৬ ভোট। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী শাহ মো. মুসলিম পান ৩ হাজার ৪৯ ভোট। নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা শ্রীধাম দাশগুপ্ত মাত্র ৬০৮ পেয়ে জামানত হারিয়েছেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জানান, এ পৌরসভায় জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী একাধিক প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও দলীয় গ্রুপিংয়ের জেরে মনোনয়ন দেওয়া হয় সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শ্রীধাম দাশ গুপ্তকে। নানা কারণে পূর্ব থেকেই শ্রীধাম গুপ্ত এলাকায় বিতর্কিত ছিলেন। এছাড়া নির্বাচনের সময় তিনি আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ভোটারদের কাছে প্রচারণা চালান বলে অভিযোগ ওঠে।
অন্যদিকে ভোটার ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের কাছে এ প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতার অভাব ছিল বলে অনেকে মনে করেন। প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলীয় নীতি নির্ধারকদের একচোখা নীতির কারণেই এ আসনে দলীয় প্রার্থীর লজ্জাজনক পরাজয় ঘটে বলে নেতাকর্মীদের একাংশের ধারণা।
এদিকে প্রথম ধাপের শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে ৯০০ ভোট বেশি পেয়ে বেসরকারিভাবে মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এমএফ আহমেদ অলি। ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে তিনি পান ৪ হাজার ৪১ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. মাসুদউজ্জামান মাসুক নৌকা প্রতীক নিয়ে পান ৩ হাজার ১৪১ ভোট। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক মেয়র মো. সালেক মিয়া নারিকেল গাছ প্রতীক নিয়ে পান ২ হাজার ৫৯৯ ভোট। অপর বিদ্রোহী প্রার্থী মো. ফজল উদ্দিন তালুকদার চামচ প্রতীক নিয়ে পান ১ হাজার ৫১০ ভোট। বিদ্রোহী প্রার্থী মো. আবুল কাশেম শিবলু পান ১ হাজার ৪৩০ ভোট এবং মোবাইল ফোন প্রতীক নিয়ে ৫২২ ভোট পান বিদ্রোহী প্রার্থী ইমদাদুল ইসলাম শীতল।
এ পৌরসভায় সদ্যবিদায়ী মেয়র ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ছালেক মিয়া। মেয়র থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে রেলের কোটি কোটি টাকার জায়গা দখল করে মার্কেট নির্মাণ, চাঁদাবাজিসহ সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। যে কারণে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ব্যাপারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় স্থানীয় ভোটারদের মাঝে। যদিও এবারের নির্বাচনে ছালেক মিয়াকে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। এবার মনোনয়ন দেওয়া হয় অপেক্ষাকৃত নতুন মুখ মো. মাসুদউজ্জামান মাসুককে। তবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সাবেক মেয়র ছালেক মিয়াসহ দলীয় ৪ বিদ্রোহী প্রার্থী। আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়রের প্রতি স্থানীয়দের বিরূপ ধারণা ও বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে এ পৌরসভায় নৌকার পরাজয় ঘটে বলে স্থানীয়দের ধারণা।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৩য় ধাপে অনুষ্ঠিতব্য চুনারুঘাট পৌরসভার আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সাইফুল আলম রুবেলকে। রুবেল চুনারুঘাটের আলোচিত আখল মিয়া হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামি। হত্যা মামলার আসামি রুবেলকে মনোনয়ন না দিতে যৌথভাবে হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন দলীয় ৪ জন মনোনয়ন প্রত্যাশী। কিন্তু এরপরও তাকে মনোনয়ন দেয় কেন্দ্রী থেকে। এতে এ আসন নিয়েও শঙ্কায় রয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। এছাড়া হবিগঞ্জ পৌরসভায় এখনও প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি আওয়ামী লীগ। এ আসনেও প্রার্থী মনোনয়নের ওপর নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করবে বলে মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা।