আগের সব রেকর্ড ভেঙে এবার বিশ্ববাজারে বাড়ছে রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম। যার প্রভাবে দেশের বাজারে নির্মাণ খাতের অন্যতম অনুসঙ্গ রডের দামও বাড়ছে লাগাতার।
পুরান ঢাকার বংশাল, নয়াবাজার রডের দোকান ঘুরে জানা গেল, অবকাঠামো উন্নয়নের অন্যতম অনুসঙ্গ এই নির্মাণ সামগ্রীর বিক্রি কমেছে অনেক। অনেকের হিসাব, দুমাস আগে যে পরিমাণ বিক্রি হয়েছে বর্তমানে তা নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে।
কারণ জানতে চাইলে দি প্যারাডাইজ এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী সাজ্জাদ হোসেন সোহেল বলেন, রডের দাম বাড়ছে। তাই কেনা কমিয়ে দিয়েছেন ক্রেতারা। এক-দেড় মাস আগে এ টন রডের দাম যেখানে পড়ত ৫০ থেকে ৫২ হাজার টাকা সেখানে বর্তমান দাম পড়ছে ৬৮ হাজারের ওপরে। দিনের বেশিরভাগ সময়ই তারা দোকান খুলে বসে থাকেন ক্রেতার অপেক্ষায়। তার হিসাবে রডের দাম বেড়েছে ৩৬ শতাংশের বেশি।
নিজের দোকানের সামনে চেয়ার পেতে বসে থাকতে দেখা গেল মেসার্স নিউ আকবর স্টিল হাউজের সত্ত্বাধিকারী মো. আমির হোসাইন রাজিবকে। বেচাকেনার খবর জানতে চাইলে তিনি জানান, যেভাবে প্রতিদিন দাম বাড়ছে তাতে আর কেউ নতুন করে বাড়িঘর নির্মাণে হাত দিচ্ছেন না। আবার যারা আগে কাজ শুরু করেছেন তাদেরও আর রড কিনতে দোকানে আসতে দেখা যাচ্ছে না। তার দোকানে বিক্রি নাই বললেই চলে।
রডের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সম্পর্কে জানতে কথা হল আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন রিহ্যাবের সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূইয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়লে তা আসলে দিন শেষে টানতে হয় ফ্ল্যাটের ক্রেতাদের। তাই এই রডের দাম বৃদ্ধির প্রভাবও পড়বে ক্রেতাদের ওপর।
ঠিকাদারদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কন্সট্রাকশন- বাসির সভাপতি প্রকৌশলী এস এম খোরশেদ আলম জানান, এভাবে রডের দাম হঠাৎ বাড়তে থাকায় চলমান কাজ সময়মতো শেষ করা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন তারা। কাজে এরইমধ্যে ধীরগতি নেমে এসেছে। তাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কারণ, তারা যখন টেন্ডার জমা দিয়েছিলেন সেখানে এই নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়তে শঙ্কায় বর্ধিত মূল্য নির্ধারণের সুযোগ ছিলো না। অথচ এখন বর্ধিত দামে কিনতে হচ্ছে।
তিনি জানান, স্টিল নির্ভর যে কোন অবকাঠামো নির্মাণে রডের দরকার হয় ২৫ ভাগ। আর এই রডের দাম যদি ২৫ ভাগ বেড়ে যায় তাহলে পুরো প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায় ৬ থেকে ৭ শতাংশ। অথচ বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে কোন প্রকল্প থেকে ৫ শতাংশ লাভ করা যায় না।
এই প্রকৌশলী জানান, বর্তমানে স্ক্র্যাপের দাম বাড়ছে; এটা ঠিক। কিন্তু তারপরও সময় ও দামের ঊর্ধগতির বিবেচনায় রডের এই পরিমাণ দাম বৃদ্ধিকে যৌক্তিক মনে করছেন না তিনি।
দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্টিল প্রস্তুতকারকদের সংগঠনের মহাসচিব মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্প প্রায় পুরোপুরি আমদানি নির্ভর কাঁচামালে চলে। এবার বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ছে অনেক বেশি। বিশ্ববাজারে ইস্পাত তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম না কমলে দেশের বাজারে রডের দাম কমার কোন সম্ভাবনা নেই বলে জানান তিনি। আবার দাম বৃদ্ধির প্রবণতায় সহসাই স্ক্র্যাপের দাম কমার কোন ইঙ্গিতও দেখছেন না তিনি।
ঢাকার ডেমরা এলাকার শাহরিয়ার স্টিল মিল ঘুরেও দেখা গেল কারখানা প্রাঙ্গণে আগের মতো আর স্ক্র্যাপের মজুদ নেই। তবে তাদের সংগ্রহে যে পরিমাণ স্ক্র্যাপ আছে তা দিয়ে তাদের দৈনিক উৎপাদন সচল রাখতে কোন সমস্যায় পড়তে হবে না।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ জানান, স্ক্র্যাপের দাম বৃদ্ধির বড় একটি কারণ ২০০৮ সাল থেকে স্ক্র্যাপ আমদানি বন্ধ রাখার পর গতবছর থেকে চীন আবার এই কাঁচামাল আমদানি শুরু করেছে। চীনের স্ক্র্যাপ আমদানির সিদ্ধান্ত এবার বিশ্ববাজারে এই উপকরণের দাম বৃদ্ধির বড় একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, করোনাকালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, অস্ট্রেলিয়াসহ স্ক্র্যাপ সরবরাহকারী দেশগুলোতেও এই কাঁচামাল রপ্তানিতে স্থবিরতা নেমে এসেছে। চাহিদা-যোগানের হিসাব মিলাতে গিয়েই স্ক্র্যাপের দাম বাড়ছে।
শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ জানান, তার ব্যবসায়িক জীবনের অভিজ্ঞতায় এর আগে স্ক্র্যাপের দাম এতো বাড়তে দেখেননি তিনি। এবার এরই মধ্যে ইউরোপের স্ক্র্যাপ বিক্রেতারা এক টন স্ক্র্যাপের দাম ঠেকিয়েছেন ৫২৫ ডলার পর্যন্ত। অথচ এই ভরা মৌসুমে কখনই ৪শ’ ডলার ছাড়ায়নি। আর বছরের বাকি সময় মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রড তৈরির এই কাঁচামালের দাম থাকে ৩শ’ ডলারের মধ্যে। তবে, আশার কথা হল বিশ্ববাজারে স্ক্র্যাপের সংকট নেই। চাইলে পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, সবাই এখন হিসাব কষে আমদানি করছেন। কেউ বাড়তি মজুদ করছেন না। তাই বাজারে সংকট নেই। এমনকি পরিবহন ব্যবস্থাতেও বড় কোন বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে না তাদের।
দেশের অভ্যন্তর থেকে আসলে কতটুকু স্ক্র্যাপের যোগান আসে কতটুকু?
স্থানীয়ভাবে (ভাংরির দোকান) রড প্রস্তুতকারকরা তাদের বাৎসরিক চাহিদার প্রায় ২০ ভাগ পেয়ে থাকেন। আর স্বাভাবিক সময়ে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে পান ১০ শতাংশের মতো। বাকিটা তাদের আমদানি করতে হয়।
দেশে বর্তমানে রডের চাহিদা ৬০ লাখ টন। এর বিপরীতে দেশিয় স্টিল মিলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ৯০ লাখ টন। অর্থাৎ দেশের চাহিদা দেশের মিলগুলোর মেটানোর সক্ষমতা রয়েছে।
বাজারে রডের দাম নিয়ন্ত্রণে পরামর্শও তুলে ধরেন শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ জানান, বর্তমান ভ্যাট ব্যবস্থপনায় অনেক সঙ্গিত রয়েছে। কোথাও কোথাও একই পণ্য দুবার তিনবার ভ্যাট-ট্যাক্সের আওতায় আসছে। এতে করে ২ হাজার টাকার ভ্যাট তাদের পরিশোধ করতে হচ্ছে ৪ হাজার টাকায়। অসঙ্গতি রয়েছে অগ্রিম আয়করের ক্ষেত্রেও। ভ্যাট ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান এমন নানান অসঙ্গতি দূর করতে পারলে আন্তর্জাতিক বাজারে যাই ঘটুক না কেন বর্তমান পরিস্থিতিতেও দেশের বাজারে রডের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
রড প্রস্তুতকারকদের তথ্য, দাম বৃদ্ধির কারণে ভরা মৌসুমেও মিল পর্যায়ে এরই মধ্যে বিক্রি কমেছে ২০ শতাংশ।