গোলাপের গ্রাম সাভারের বিরুলিয়া। গ্রামের পর গ্রাম গোলাপসহ বর্ণিল ফুলের যেন এখানে স্বর্গ রাজ্য। বছরে ফুলের উৎপাদন শত কোটির উপরে। কিন্তু করোনায় সব কিছু ওলোট পালোট করে দিয়েছে। চাহিদা ও দাম কমের কারণে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হলেও সরকারি কোনো সহায়তা ফুল চাষিদের ভাগ্যে জোটেনি। তারপরও সামনের তিন মাসের কয়েকটি উৎসব ঘিরে ঘুরে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তারা।
ফুলের রাজ্য সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়ন। এক সময়ের জঙ্গল আর পতিত জমির এলাকা সাদুল্ল্যাপুর, শ্যামপুর, মোস্তাপাড়া, বাগনীবাড়ী, কাকাবো, ছোট ও বড় কালিয়াকৈরসহ ২০ থেকে ২৫টি গ্রাম এখন গোলাপ গ্রাম।
গোলাপে চাষ দিয়ে শুরু হলেও এখন বাগানের পর বাগানে নানা প্রজাতির দেশি বিদেশি বর্ণিল ফুল। চায়না গোলাপ, মিরিন্ডা গোলাপ, ইরানি গোলাপ, জারবেরা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, চন্দ্র মল্লিকা ফুলের সমারোহ এখানে।
ফুলের প্রতি ভালোবাসা থেকেই ত্রিশ বছর আগে রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা সাবেদ আলী বিরুলিয়ার সাদুল্ল্যাপুরে পতিত জমি বর্গা নিয়ে ফুল চাষ শুরু করেন। উঁচু মাটিতে ফলন ভাল হওয়ায় ধীরে ধীরে গোলাপ বাগানের পরিধি বাড়াতে থাকেন। বর্তমানে ৬৫ বছর বয়সেও ৩ বিঘা জমিতে ফুল চাষ করেন তিনি।
নব্বই দশকের পর থেকে সাবেদ আলীর দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করেন এলাকার কৃষক, বেকার যুবকরা। ধীরে ধীরে বিরুলিয়া ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে পতিত পড়ে থাকা উঁচু জমিতে ফুল চাষ বাড়তে থাকে। এক সময় চাষিরা তুরাগ নদীতে খেয়া পার হয়ে রাজধানীর কাটাবনে ঝাঁকা বোঝাই করে ভোরে ফুল নিয়ে যেতো। তবে ফুলের গালিচার গ্রামগুলোর মানুষের ভাগ্য বদলে যেতে থাকে দ্রুত।
বিপণনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। ঢাকায় নয় ২০১১ সালের পর থেকে ইউনিয়নের ছোট কালিয়াকৈরে প্রতি রাতেই বসে বিশাল ফুলের হাট। তাতেও বাজার চাহিদা পূরণ না হওয়ায় মোস্তাপুর গ্রামে বসে আরেকটি ফুলের হাট।
ফুলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ফুলপ্রেমীরা ছুটে আসেন বিরুলিয়ার গোলাপ গ্রামে। ফলে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ফুলের বাহারি দোকান। দোকানগুলোর মালিক বাগান চাষিরাই।
দোকান থেকে নয় অধিকাংশ পর্যটক আনন্দ আর বিনোদনের জন্য সরাসরি বাগানে ঢুকে ছবি তুলে নিজেকে স্মরণীয় করে রাখতে চান। সে সাথে কম দামে ফুল কেনেন বাগান থেকেই।
তবে করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে ব্যাপক ধস নামে ফুল বাণিজ্যে। কোটি কোটি টাকার ফুল নষ্ট হয়ে যায়। ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন কৃষকেরা। ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত তিনটি ধাপে বিভিন্ন উৎসবকে লক্ষ্য করে কৃষকরা ক্ষতি পোষাতে বাগান পরিচর্যায় ব্যাপক পরিমাণ অর্থলগ্নি করেন। ডিসেম্বরেই গোলাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় বিরুলিয়ার মাঠ-প্রান্তর। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক ফুল উৎপাদন হওয়ায় কৃষকদের মুখে ছিল হাসির ঝিলিক। কিন্তু তা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যায়।
চাষিদের অভিযোগ, মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বাগানে যে পরিমাণ ফুল উৎপাদিত হয়েছিলো তার অর্ধেকেরও বেশি ফুল পানির দামেও বিক্রি করতে পারেননি। একটি গোলাপ এক থেকে দেড় টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। অথচ খরচ হয়েছে গোলাপ প্রতি গড়ে দুই টাকা। একটি ফুলের তোড়াতে ৫২টি ফুল বিক্রি করেছেন ১শ টাকায়। ২০১৯ সালে তারা বিক্রি করেছেন ৫শ থেক ১হাজার টাকায়।
ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কয়েকটা উৎসব রয়েছে। এজন্য এখনি বাগান থেকে গোলাপ কেটে ফেলতে হবে। একটি গোলাপের কুড়ি থেকে বছরে পর্যায়ক্রমে চারটি গোলাপের জন্ম হয়।
ফুল চাষিরা জানান, চায়না গোলাপ বাগান থেকে কাটার পর ১০ থেকে ১২দিন পানিতে ভিজিয়ে সতেজ রাখা যায়। কিন্তু দেশীয় প্রজাতির গোলাপ ২ থেকে তিন দিনের বেশী দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় উন্নত জাতের গোলাপ চাষ করেও বিদেশে রপ্তানিতে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে ফুল চাষিদের। তাদের দাবি, সরকারি উদ্যোগে ফুল প্রিজারভেটিভ ব্যবস্থাপনা করা গেলে কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
সাভার উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বিরুলিয়ার লাল মাটিতে প্রায় দু'হাজার বিঘা জমিতে ফুল চাষ হয়। আর প্রতি বিঘাতে বছরে আয় হয় ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা।