কুমিল্লায় দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন হত্যাকাণ্ডের দু বছর হলো। চাঞ্চল্যকর এ খুনের পরিকল্পনাকারী ও মূল ঘাতকরা আজও রয়ে গেছে অধরা। এদিকে এ খুনের মামলাটি থানা পুলিশের পর এখন তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কুমিল্লা। পিবিআইয়ের দাবি, তারা হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটন করেছে।
তবে ঘাতকরা গ্রেফতার না হলেও ক্রমেই উন্মোচিত হচ্ছে দেলোয়ার হোসেন খুনের রহস্যের জট। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জের ধরেই দেলোয়ারকে হত্যা করা হয়।
আর এ হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুছ সাত্তার। কাউন্সিলর কার্যালয়ে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়। কিলিং মিশনে অংশ নেয়া এক আসামি আনোয়ার হোসেনের ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি থেকে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
দেলোয়ারের ঘাতক এজহারনামীয় প্রধান আসামি রেজাউলের সহযোগী আনোয়ার হোসেনকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়। পরদিন সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এতে খুনের মূল পরিকল্পনাকারী কাউন্সিলর সাত্তার ও কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া আসামিদের নাম উঠে আসে।
এক আসামির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার পরও কেন হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়নি? এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ১১ নভেম্বর চৌয়ারা এলাকায় জিল্লুর রহমান চৌধুরী জিলানী হত্যা মামলায় কাউন্সিলর সাত্তার ২ নম্বর আসামি হওয়ার পর এলাকা থেকে আত্মগোপনে চলে যায়। এর আগে সে এলাকায় অবস্থান করেছিলেন। এতদিন সময় পাওয়ার পরও কেন কাউন্সিলর সাত্তারকে গ্রেফতার করা হলো না ? তা রহস্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
জানা যায়, কুমিল্লা নগরীর শামবক্সি (ভল্লবপুর) এলাকায় ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর রাতে একদল সন্ত্রাসী মোটর সাইকেলে করে এসে দেলোয়ারকে ঘেরাও করে হামলা চালায় এবং মাথায় গুলি করে তাকে হত্যা করে। ঘটনার পরদিন নিহতের ভাই শাহাদাত হোসেন নয়ন বাদী হয়ে সদর দক্ষিণ মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় ওই গ্রামের রেজাউল করিম ও কাউছারসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়। মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে পিবিআই। নিহত দেলোয়ার হোসেন রাজনীতির পাশাপাশি হাউজিং অ্যাস্টেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক ও কেটিসিসিএ লি. এর পরিচালক ছিলেন।
নিহত দেলোয়ারের স্ত্রী জিলকজের নেছা বলেন, সন্ত্রাসীরা আমাকে বিধবা ও আমার দুই শিশু সন্তানকে এতিম করেছে। আমার দুই ছেলে রাইয়ান (৭) ও সাফোয়ান (৪) যখন তাদের বাবাকে খুঁজে বেড়ায় তখন বুকভরা কান্না চেপে রাখতে পারি না। নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাড়িতে থাকি না। এক আত্মীয়ের বাসা থেকে আরেক আত্মীয়ের বাসায় ঘুরে দিন কাটাচ্ছি। আমি খুনিদের ফাঁসি চাই।
মামলার বাদী শাহাদাত হোসেন নয়ন বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী কাউন্সিলর আবদুস সাত্তার এক আসামির আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তা স্পষ্ট হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর প্রশাসনের কাছে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছিলাম সাত্তার খুনের মূল পরিকল্পনাকারী। দেলোয়ারের জীবদ্দশায় সে বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়েছিল। মামলার এজাহারে তার নাম আনতে চেয়েছিলাম। তৎকালীন সদর দক্ষিণ মডেল থানার ওসি’র কারসাজির কারণে এজাহারে কাউন্সিলর সাত্তারের নাম দিতে পারিনি। এ মামলার প্রধান আসামি রেজাউল এলাকায় ২টি হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক ও ডাকাতিসহ বেশ কয়েকটি মামলার আসামি। ঘটনার দিন রেজাউলকে বিবির বাজার বর্ডার থেকে রিসিভ করেছিল কাউন্সিলর সাত্তারের দেহরক্ষী হিসেবে পরিচিত শাওন। কাউন্সিলর সাত্তার ও রেজাউলদের নানা অপরাধ ও অপকর্মের প্রতিবাদী ভূমিকার কারণে আমার ভাইকে তারা পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে। অবিলম্বে মূল ঘাতকদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানান তিনি।
এদিকে বৃহস্পতিবার (২৬ নভেম্বর) দেলোয়ার হত্যাকাণ্ডের দুই বছর উপলক্ষে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করে মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠিত হবে বলেও তিনি জানান।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আ ফ ম আহসান উদ্দিন টুটুল ও ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান রাতুল বলেন, সাবেক ছাত্রনেতা দেলোয়ার ভাই ছিলেন দলের দুঃসময়ের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা। সে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার। তদন্ত সংস্থা পিবিআই আসামিদের নাম ও পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে। পিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হওয়া আসামি আনোয়ার হোসেন এ হত্যার রহস্য উন্মোচন করে আদালতে জবাবন্দি দেওয়ার পরও কেন মূল পরিকল্পনাকারী কাউন্সিলর সাত্তারসহ কিলিং মিশনের সদস্যরা গ্রেফতার হচ্ছে না তা রহস্যজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ। তারা গ্রেফতার হলে পরবর্তীতে গত ১১ নভেম্বর একই এলাকায় জিলানী খুন হতো না বলে মনে করেন তিনি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই-কুমিল্লার পরিদর্শক মতিউর রহমান বলেন, মামলার তদন্তে আমরা শতভাগ সফল। কারা ও কেন দেলোয়ারকে হত্যা করেছে সবই জানা সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মামলার প্রধান আসামি পলাতক রেজাউলের সহযোগী এজাহার বহির্ভুত আনোয়ার হোসেন নামের একজনকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর গ্রেফতারের পর দেলোয়ার হত্যা রহস্য বের হয়ে আসে। জিজ্ঞাসাবাদে সে এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। পরদিন সে আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দেলোয়ার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী কাউন্সিলর আবদুস সাত্তারসহ অপর খুনিদের নাম বলেছে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র ও মোটরসাইকেল উদ্ধার এবং আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।