ক্রীড়া দুনিয়ায় সবচেয়ে আলোচিত আসর দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ অলিম্পিক্স। তবে, ক্রীড়া বিশ্বে জনপ্রিয়তার শীর্ষে শুধু একটি খেলা। তা হলো ফুটবল। তাবত দুনিয়াকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে রাখে এই একটি খেলা 'ফুটবল'।
বাংলাদেশও সবার আগে ক্রীড়ার মধ্যে ফুটবল ছিলো সবচেয়ে আকর্ষণীয় খেলা। যার অন্যতম স্রষ্টা আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি তারকা ফুটবল ঈশ্বর দিয়াগো ম্যারাডোনা। তার অন্যতম কারণ, ৬০ কিংবা ৭০'র দশকে ফুটবলের আরেক কিংবদন্তি পেলের খেলা এতোটা টেলিভিশনের পর্দায় বাংলাদেশের মানুষ উপভোগের সুযোগ পায়নি। তবে, ৮০'র দশকে রঙীণ টেলিভিশনের দুনিয়ায় কেবলই প্রবেশ করা বাংলাদেশ, ম্যারাডোনার আন্তর্জাতিক মঞ্চ মাতানোর শুরুটা উপভোগ করেছে প্রাণভরে।
যার শুরুটা মূলত ১৯৮৬ বিশ্বকাপে দিয়াগো ম্যারাডোনার একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের স্বপ্নীল ট্রফি জেতার মধ্য দিয়ে। অধিনায়ক ম্যারাডোনার অসম্ভব ফুটবল দক্ষতায় পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করে আর্জেন্টিনা।
দিয়াগোর প্রতাপে মন্ত্রমুগ্ধ ফুটবল শৈলীতে দিওয়ানা হয় এদেশের বুড়ো-ছোরা থেকে সববয়সী সমর্থকরা। ম্যারাডোনার মাধ্যমেই বাংলাদেশের অনেকেই জানতে পারে আর্জেন্টিনা ফুটবল এক পরাশক্তির দল। তাই ম্যারাডোনা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে আলাদা করে জায়গা করে নেয় '৮৬ বিশ্বকাপ থেকে।
সেই থেকে ম্যারাডোনা মানে বাঙালির এক আলাদা আবেগের জায়গা সৃষ্টি হয় ফুটবল হৃদয়ে। ৮০'র দশকে তাই ফুটবলে প্রবল জোয়ার ম্যারাডোনা নামে। কারণ তখন এদেশের মানুষের কাছে ম্যারাডোনা মানেই আকাশি-নীল জার্সি, ম্যারাডোনা মানে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলকে অকুন্ঠ সমর্থন দেয়া। ম্যারাডোনা মানে নিখাঁদ বিনোদনের ৯০ মিনিটের রুদ্ধশ্বাস ফুটবল। ম্যারাডোনা মানে বিজয় উদযাপনে মত্ত হওয়া উন্মুক্ত প্রেম।
লোকমুখে শোনা যায়, ম্যারাডোনার ফুটবল উপভোগ করতেই নাকি এদেশের টেলিভিশনের পর স্যাটেলাইটের আগমনেও নাকি প্রসার ঘটে। ম্যারাডোনা যখন তিক্ততা নিয়ে ১৯৮৪ সালে ক্লাব বার্সেলোনা ছেড়ে পাড়ি জমায় ইতালিয়ান ক্লাব নাপোলিতে। বিশ্বমঞ্চের পর এক ম্যারাডোনার ফুটবল উপভোগে বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টি কাড়ে ইতালির ফুটবল লিগ সিরিআ। বিশ্বজুড়ে নাপোলিরও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে।
ম্যারাডোনার ফুটবল জাদুতে নাপোলির ইতিহাসের সফলতম যুগ পার করে। জাতীয় দলের পর ম্যারাডোনার সাফল্যের পালকে ১৯৮৬–৮৭ ও ১৯৮৯–৯০ মৌসুমে সিরিআ চ্যাম্পিয়নশিপ ছাড়াও ১৯৮৯–৮৮ ও ১৯৮৮–৮৯ মৌসুমে তারা রানার-আপ হয় নাপোলি। একবার কোপা ইতালিয়া জেতানোর পর সর্বশেষ ১৯৯০ সালে ইতালীয় সুপার কাপ নাপোলিকে জেতান দিয়াগো। আর ১৯৮৭–৮৮ মৌসুমের সিরিআ-তে ম্যারাডোনা সর্বোচ্চ গোলদাতা নির্বাচিত হন।
জাতীয় দলের পর ক্লাব ফুটবলে ম্যারাডোনার এমন ঈর্ষণীয় সাফল্য তিনি ফুটবল দুনিয়ায় হয়ে উঠেন নায়ক থেকে মহানায়কে। টেলিভিশনের পর্দা থেকে পত্রিকার পাতায় বড় ছবিতে নিয়মিতই ছিলেন আর্জেন্টাইন এই সুপারস্টার। যে কারণে বাংলাদেশের ফুটবল প্রেমিদের নয়নমনি হয়ে উঠেন। সেই থেকেই ম্যারাডোনা বাংলাদেশের মানুষের মনের গহিনে আলাদা করে জায়গা করে নেয়। সাথে এদেশের মানুষ ম্যারাডোনাকে ভালোবেসে অজান্তেই আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের প্রেমে পড়ে। ম্যারাডোনার মাধ্যমেই বাংলাদেশের ফুটবল সমর্থকদের একটা বড় গোষ্ঠীর জন্ম নেয় আর্জেন্টিনা ফুটবল দল সমর্থনে।
কিন্তু কি অদ্ভূত দেখুন না। যে মানুষটি বাংলাদেশের কেউ, এক্কেবারে কেউই না! না, এদেশের মাটির গন্ধ আছে তার শরীরে, না এদেশের সংস্কৃতি, ভাষা? না, নেই। কোন কিছুর সাথেই মিল নেই। কিন্তু পৃথিবীর মায়া ছেড়ে দিয়াগো ম্যারাডোনার প্রস্থানে কোন আপনজন হারানোর বেদনায় বাংলাদেশের ফুটবল সমর্থকরা কাঁদছে দু'চোখ ভিজিয়ে...