গত কিছুদিন যে বিষয়টি নিয়ে আমি সবচেয়ে বেশী ভেবেছি সেটি হল শিরোনামের এই প্রশ্নটা। যোগ-বিয়োগ, গুন-ভাগ করতে করতে একটা সময় মনের মধ্যে একটা টালি খাতাও তৈরি করেছি। টালি খাতার এক দিকে কেনো মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবার ক্ষেত্রে ক্যাশ-আউট চার্জ কমাতে হবে তার যুক্তিগুলো সাজিয়েছি; আর অন্যদিকে কেনো কমানো যাবে না তার হিসেব।
টালিটা করার পর কাউকে আর বলে দিতে হবে না সরল এই অংকের ফলাফল কি?
ওই সহজ সরল অংকের ফলাফলের ওপরেই ক্যাশ-আউটের জন্যে ‘নগদ’ তার গ্রাহকদের কাছ থেকে মাত্র এক শতাংশের নীচে চার্জ করছে। ফলে ‘নগদ’ এর গ্রাহকরা এখন এক হাজার টাকা ক্যাশ-আউটে ‘নগদ’কে মাত্র ৯ দশমিক ৯৯ টাকা চার্জ দিচ্ছেন। পহেলা অক্টোবর থেকে চালু হয়েছে নতুন এই চার্জ। অ্যাপ দিয়ে যারা লেনদেন করছেন তাদের জন্যে আপাততও এই সুবিধা। আর অ্যাপ ব্যবহার না করে যারা মোবাইল ফোন অপারেটরের ইউএসডি ব্যবহার করে ক্যাশ-আউট করবেন খরচটি তাদের জন্যে হবে এক হাজার টাকায় ১২ দশমিক ৯৯ টাকা। যদিও এর ওপরে গ্রাহককে সরকার নির্ধারিত ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে।
এই যে গত এক দশক ধরে ‘হাজারে ২০ টাকা’র একটি খপ্পরে আমাদের মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবার গ্রাহকরা পড়ে ছিল, সেখান থেকে তাদেরকে বের করে আনার জন্যে এটি একটি বড় পদক্ষেপ হবে বলেই আমার বিশ্বাস।
চলেন এবার টালিখাতার হিসেবটা একটু মিলিয়ে আসি।
এখন আমরা যারা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবা দিচ্ছি তাদের প্রত্যেকের জন্যে সেবার সঙ্গে সঙ্গে এটি কিন্তু ব্যবসাও। টিকে থাকতে হলে এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনীয় সেবা নিয়ে আসতে হলে আয় করতেই হবে। আর আয় কোথা থেকে আসবে – ক্যাশ-আউট চার্জই তো এক্ষেত্রে প্রধানতম মাধ্যম।
তাহলে তো নিঃসন্দেহে ক্যাশ-আউট চার্জ যতো বেশী হবে এমএফএস অপারেটরগুলোর আয় ততো বেশী হওয়ার সম্ভাবনা! হিসেবটা সহজ। কিন্তু কতোটা আয় করবো বা আয় ধরে রাখতে গিয়ে গ্রাহকের ওপর কতোটা বোঝা চাপাবো সেটিও তো আলোচনায় থাকা দরকার। এখানে নিশ্চয়ই একটা ভারসাম্য প্রয়োজন। কোভিডের পুরোটা সময় সেটাই ঘুর পাক খেয়েছে আমার মাথায়।
‘নগদ’ এর প্রস্তুতি পর্ব থেকেই আমরা দেখছি হাজারে ২০ টাকা গ্রাহকের ওপর একটি নির্যাতন। এই শৃঙ্খল থেকে গ্রাহকদেরকে মুক্তি দেওয়াও আমাদের জন্যে খুবই প্রয়োজনীয় কাজের তালিকায় ছিল। সে কারণে কোভিডের শুরুতেই কিন্তু আমরা পাঁচ ধরনের ছোট ব্যবসায়ীদের হাজারে মাত্র ৬ টাকায় লেনদেন করার সুযোগ করে দিয়েছিলাম যাতে তাদের ব্যবসায়ীক লেনদেনে সুবিধা হয়। ‘স্বাধীন’ নামের এই প্যাকেজের আওতায় ওই সব ব্যবসায়ীরা কোভিডের কড়াকড়ির সময়েও খানিকটা স্বস্তিতে লেনদেন করতে পেরেছেন। বলতে পারেন ওটা ছিল আমাদের জন্যে পরীক্ষামূলক এক ব্যবস্থা। কিন্তু সেই সুবিধা আমরা এখনো চালু রেখেছি।
তাহলে টালি খাতার এক দিকে বসালাম হাজারে ২০ টাকার খড়গ। আর অন্যদিকে দিচ্ছি ডিজিটাল লেনদেনে গ্রাহকদেরকে আরো বেশী উৎসাহী করতে ক্যাশ-আউট রেট অর্ধেকে নামিয়ে আনার হিসেব। আমার বিশ্বাস দ্বিতীয়টাই আমাদেরকে জয় যুক্ত করবে। অর্থনীতির দিগন্তকে আরো প্রসারিত করতে ক্যাশ-আউটের খরচ কমিয়ে আনা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশকেও জয়যুক্ত করবে।
আমার মনে প্রশ্নের দ্বিতীয় যে দিকটি ছিল সেটা হল – শুরুতে যে কয়জন গ্রাহক দিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম এখন তো গ্রাহক অনেক বেড়েছে। বেড়ে বেড়ে কয়েক কোটি হয়ে গেছে; সে অনুসারে লেনদেনও বেড়েছে; সেই সঙ্গে এমএফএসগুলোর আয়ও বেড়েছে। তাহলে এখনো ক্যাশ-আউটের হার কেনো আগেরই মতো থাকবে? দশ বছর আগের হিসেব আর এখনকার হিসেব তো এক হতে পারে না। টালিখাতার এক দিকে এই যুক্তি রাখলে অন্যদিকে আর কিছুই বলার থাকে না। সুতরাং সেখানে ক্যাশ-আউট চার্জ কমানোর পক্ষেই যেতে হয়েছে আমাকে।
তৃতীয় আলোচনাটা যদি এমন হয় – নিজেদেরকে যারা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবার সবচেয়ে বড় এবং সফল ভাগিদার হিসেবে দাবি করেন তারাই কেন লেনদেনে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী চার্জ করবেন? কোনো এখানে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে খরচ কমিয়ে বরং গ্রাহকের ওপর থেকে চাপ কমানো হবে না? আমিও ভাবি এই অপবাদ থেকে দায় মুক্তি দিনে হবে। ফলে ক্যাশ-আউট চার্জ কমানোই একমাত্র পথ।
প্রযুক্তি ব্যবহারে যে কোনো ব্যবসার খরচ কতোটা কমানো সম্ভব সেটা এখন আর কার না জানা। তবে এটি কিন্তু প্রথম থেকেই আমাদের লক্ষ্য ছিল। উদ্ভাবনী প্রযুক্তিকে আমরা এমনভাবে ব্যবহার করতে পেরেছি যে সবচেয়ে কম খরচে এবং সবচেয়ে কম সময়ে আমরাই গ্রাহক নিবন্ধন করতে পারছি। আর একইভাবে লেনদেনের সবচেয়ে বেশী নিরাপত্তাও আমরাই দিতে পারছি। এসব কারণেই সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের খরচও সবচেয়ে কম। সুতরাং তার কিছুটা সুবিধা তো গ্রাহকে দেওয়াই যায়।
পরের আলোচনাটা হতে পারে এমন – কেবল টাকা ছাপা এবং টাকার ব্যবস্থাপনা করতেই বছরে বাংলাদেশের নয় হাজার কোটি টাকা খরচ হয়; আমারা তো ডিজিটাল লেনদেন বাড়িয়ে দেশের এই টাকাটা তো অন্তত বাঁচাতে পারি। আমাদের মতো দেশের উন্নয়নে কিন্তু এই নয় হাজার কোটি টাকা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। সুতরাং আমারা যারা ডিজিটাল সেবা নিয়ে কাজ করি তাদের একটা দায়িত্ব এখানে থেকেই যায়। সেই দায়িত্বটাই হল সেবার খরচকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা। আর খরচ কমালে লেনদেন বাড়াবেই সুতরাং আমাদের আয়ও ফিরে আসবে আগের জায়গাতে।
এই বিষয়গুলো শুরু থেকেই ভাবাচ্ছিল আমাকে। আর সেকারণে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবেই ‘নগদ’ টু ‘নগদ’ লেনদেন একেবারে ফ্রি করে দিই আমরা। যেখানে অন্য অনেক এমএফএস অপারেটর কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যকার লেনদেনেও গ্রাহকের গাট কাটছে।
এখানে আমার একটা বক্তব্য হল – চাইলেই সরকার এখানে একটা ভূমিকা নিতে পারে। মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে যেমন কল রেট, নতুন প্যাকেজ অনুমোদন দেওয়াসহ অনেক ক্ষেত্রেই সরকার নানা বিধি-নিষেধ দিয়ে দেয় এক্ষেত্রেও তেমনটা হতে পারে। ক্যাশ-আউটের সর্বোচ্চ রেট কি হবে সেটিও সরকার নির্ধারণ করে দিতে পারে। কব্জির জোর বেশী বলেই যা খুশি তাই যেন কেউ না করতে পারে সে দিকেও সরকারের নজর দেওয়ার দাবি রাখে।
এমএফএস অপারেটররা যেহেতু আর্থিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে সে কারণে এখানে সরকারের নজরদারী আরো বেশী হওয়া প্রয়োজন। সত্যিকারের ডিজিটালাইজেশন হচ্ছে কিনা – মানুষের জীবন-মানের পরিবর্তন করতে গিয়ে আসলে তাকে কতোটা চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে এসব নিশ্চয়ই দেখার লোক থাকা দরকার।
আমার মনের মধ্যে থাকা যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তিগুলো যখন একের পর এক ওই টালিখাতায় বসিয়ে ফেললাম তখন আমার হিসেবও পরিষ্কার। সুতরাং তার ফলশ্রুতিতেই এখন ‘নগদ’ এর গ্রাহকরা ক্যাশ-আউট করতে গেয়ে আরো সাশ্রয়ী সেবা পাবেন। বলতে পারেন, সিদ্ধান্তটা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোভিডের চলমান সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চিন্তাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমরা যেহেতু বিশ্বাস করি – মানুষ বাঁচলে, দেশ বাঁচবে – সুতরাং প্রয়োজনে আমরাই মানুষের পাশে দাঁড়াবো সেটাই স্বাভাবিক।
লেখক: তানভীর এ মিশুক, ডাক বিভাগের মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবা ‘নগদ’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক।