সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইসরাইলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব বহুদিনের। চলতি বছরের জুনে আবুধাবি থেকে দুটি বিমান ভর্তি করে চিকিৎসা সহায়তা পাঠানো হয় তেল আবিবে। বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে করোনা মোকাবিলার ঘোষণাও দেয় দু’পক্ষ। ২০২০ সালে দুবাইয়ে ওয়ার্ল্ড এক্সোপে আমন্ত্রণ জানানো হয় ইসরাইলকে। যদিও করোনা মহামারীর কারণে প্রদর্শনীটি স্থগিত হয়।
২০১৮ সাল থেকে ইসরাইলের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সরাসরি সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করছেন। ইরানকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক জোটের সদস্য হিসেবে আমিরাত-ইসরাইল একে অপরের ঘনিষ্ঠ বলেও স্পষ্টভাবে স্বীকৃত।
ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে নিপীড়িত, নির্যাতিত, বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা। ফিলিস্তিনের ভূমি উদ্ধারে যুদ্ধের নামে ফিলিস্তিনিদের উপর সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় আরবরা-তথাকথিত আরব-ইসরাইল যুদ্ধের মাধ্যমে।
নির্লজ্জের মতো শুধু আর্থিক আর ক্ষমতায় টিকে থাকার কথা চিন্তা করে ইসরাইলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে বহু আরব রাষ্ট্র। এতে রয়েছে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী ক্ষমতাসীনরাও; যা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে, আল আকসার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাসঘাতকতা।
জর্ডান, মিশরের পর সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের সঙ্গে নিজেদের গোপন সম্পর্ককে প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে। গোপন সম্পর্ককে প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হলেও তাদের সম্পর্ক বরাবরই অনৈতিক।
এখন ইসরাইলের সঙ্গে জঘন্য এ সম্পর্ক স্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছে ওমান, বাহরাইনসহ আরো অনেকে। সৌদি আরব, কাতারও অনানুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। এ অবস্থায় জাতি ভাইদের সহায়তায় নিজেদের ভূমি উদ্ধার করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ফিলিস্তিনিদের চলমান সংগ্রাম কিছুটা হলেও হুমকিতে পড়েছে।
এছাড়া, হোয়াইট হাউস থেকে যৌথ বিবৃতিতে বৃহস্পতিবার যখন বলা হলো, মধ্যপ্রাচ্যের দুই রাষ্ট্র ইসরাইল-সংযুক্ত আমিরাত নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে একমত হয়েছে; তখন তাদের মধ্যেকার সম্পর্ককে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার ‘ক্ষণটি’ নিয়ে অনেকে বিস্মিত হয়েছেন।
ঘোষণাটি এলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক ৮২ দিন আগে। এ নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার জন্য লড়বেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও জনমত জরিপ আভাস দিচ্ছে, নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ট্রাম্প উতরে যাবেন।
‘ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণা ঘোষণা’
মিডল ইস্ট মনিটরকে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান দি আরব সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক খালির জাহশান বলেন, হোয়াইট হাউসের বিবৃতি নির্বাচনী প্রচারণা ঘোষণার মতো। যার মাধ্যমে ৩ নভেম্বর মার্কিন নির্বাচনের আগে ট্রাম্প প্রশাসনকে জয়ী আখ্যা দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। আমিরাত-ইসরাইল স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণাকে ট্রাম্প প্রশাসন নির্বাচনী প্রচারণায় কাজে লাগাতে চাইছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বিনইয়মিন নেতানিয়াহু পশ্চিমতীরের ভূখণ্ডে সার্বভৌমত্ব ঘোষণা বাতিল করবেন। উভয়পক্ষের প্রতিনিধিরা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সাক্ষাত করে কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপনের রূপরেখা তৈরি করবেন।
মার্কিন প্রশাসন পরে জানিয়েছে, দু’পেক্ষর কয়েকটি বৈঠক হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত হবে। জাহশান বলেন, তাদের মধ্যে মৌলিক মূলনীতি বিষয়ে হয়তো কোনো ঐক্যই হয়নি। হোয়াইট হাউসের বৈঠকের ছবিকে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করবেন ট্রাম্প। যা ট্রাম্পকে পুনর্নির্বাচনে সহায়তা করতে পারে। নেতানিয়াহুও তার থেকে ফায়দা নেবেন। কারণ তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে প্রতিদিন অকল্পনীয় বিক্ষোভ হচ্ছে।
যুদ্ধবিরোধী নারীবাদী সংগঠন কোড পিংকের জাতীয় সমন্বয়ক আরিয়েল গোল্ডও জাহশানের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেছেন। বলেন, আমিরাত-ইসরাইল চুক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, ইসরাইল প্রধানমন্ত্রী এবং আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স তিনজনকেই ব্যক্তিগতভাবে ফায়দা নিতে সহায়তা করবে।
তিনি বলেন, মহামারীর কারণে হাজার হাজার মার্কিন মারা যাচ্ছেন, ট্রাম্প চাচ্ছেন এ ধ্বংসযজ্ঞ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের চোখ সরাতে। আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স উদ্দেশ্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে অভিযোগ রয়েছে তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া। আর নেতানিয়াহু চান সরকারবিরোধীকে শান্ত করতে।
চুক্তি তাদের তিনজনকে সমানভাবে উপকৃত হতে সহায়তা করবে। তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হলো ফিলিস্তিনিরা। বলেন গোল্ড।
পরিকল্পনা কতটা কাজে দেবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে আগে আমিরাত-ইসরাইল চুক্তি ট্রাম্পকে ইতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। প্রাথমিক ফলাফলও সন্তোষজনক। তবে তা ভোটারদের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে না বলেও মনে করেন তারা।
গণমাধ্যম বিশ্লেষক এবং ডেমোক্র্যাটরাও চুক্তির প্রশংসা করেছেন। নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট থমাস ফ্রেইডম্যান চুক্তিকে ‘ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকম্প’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এটি মার্কিন জাতীয়তাবাদী, মধ্যপন্থী ইসলামপন্থী এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের সঙ্গে চলমান সংঘাত নিরসনের পক্ষে যারা তাদের লাভবান করবে বলে মনে করেন তিনি।
ফরেন ফলিসি ম্যাগাজিন চুক্তিকে ‘ট্রাম্পের প্রথম দ্ব্যর্থহীন কূটনৈতিক সফলতা’ বলে শিরোনাম করেছে। এনবিসি শিরোনাম করেছে, আমিরাত-ইসরাইল চুক্তি ট্রাম্পের প্রথম খাঁটি কূটনৈতিক সফলতা।
ট্রাম্পের জামাতা এবং হোয়াইট হাউসের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার শুক্রবার বলেছেন, ঐতিহাসিক আমিরাত-ইসরাইল চুক্তি সম্পাদনে সহায়তা করেছেন তিনি।
বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে কী হবে আমাদের শুধু তাতে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। সিএনএনকে তিনি বলেন, আমি মনে করি এ চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনদের আরো নিরাপদ করবে। ওই অঞ্চলে মার্কিন সেনা উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তাও কমিয়ে দেবে।
কুশনার বলেন, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে ব্যবহার করে তরুণদের উগ্রবাদী মতাদর্শে অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে। আমিরাত-ইসরাইল চুক্তি উগ্রবাদী মতাদর্শকে দমনে সহায়তা করবে।
মার্কিন বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষক এবং ইসরাইলপন্থী রাজনীতিবিদরা চুক্তি নিয়ে মাঠ গরম করলেও মার্কিনরা ব্যস্ত মহামারীর তাৎক্ষনিক ধ্বংসযজ্ঞ মোকাবিলা এবং আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে।
জাহশান বলেন, মার্কিন নির্বাচনে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিকে ব্যবহার করা একটি জটিল। আপনি এ চুক্তির উপর ভিত্তি করে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবেন না।
গোল্ড বলেছেন, মার্কিন ভোটাররা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বেশি আগ্রহী। ইহুদি আমেরিকান, যারা এ চুক্তিতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে তাদের অধিকাংশ ডেমোক্র্যাটের বিশ্বস্ত ভোটার।
’এ চুক্তি ট্রাম্পকে খুব সহায়তা করবে বলে দেখতে পাচ্ছি না। তবে ফিলিস্তিনিদের ক্ষোভের কারণে তাকে মূল্য দিতে হবে। বলেন, গোল্ড।
ডেমোক্র্যাটদের প্রতিক্রিয়া
মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বাইডেন বহুদিন ধরে ইসরাইলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করেছেন। ট্রাম্পের নাম উল্লেখ না করে চুক্তিকে তিনি স্বাগত জানিয়েছে। তিনি, আবুধাবির সিদ্ধান্তকে সাহসী এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত বলে আখ্যা দিয়েছেন।
যৌথ বিবৃতিতে প্রাথমিক চুক্তিকে ট্রাম্পের অর্জন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বাইডেন বলছেন, ওবামা-বাইডেন প্রশাসনের আরব শান্তি পদক্ষেপসহ অনেক প্রশাসনের অবদান রয়েছে এ চুক্তিতে। কারণ তারাই ইসরাইলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্থাপনে কাজ শুরু করে।
শত্রু এবং প্রতিপক্ষের জন্য এটি বার্তা। যেখানে কোনো কিছুই ছিল না এখন অনেক কিছু হচ্ছে। মার্কিন কূটনীতি চাইলে সব কিছু পারে। বিবৃতিতে বলেন বাইডেন।
কংগ্রেসের বৈদেশিক নীতি বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান এলিয়ট এঞ্জেল বলেন, চুক্তি আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বলেন, আমি আশা করি এ সফলতা অন্যান্য দেশকে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে উৎসাহী করবে। যা ফিলিস্তিনিদের জন্য শান্তি নিশ্চিতে জরুরি।
কংগ্রেসের স্পিকার ডেমোক্র্যাট দলীয় শীর্ষ নেতা ন্যান্সি পেলোসি চুক্তিকে ভালো খবর আখ্যা দিয়ে স্বাগত জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ইসরাইলের একতরফা সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার বিরোধিতা করে যাবে কংগ্রেস। কারণ তেল আবিবের এ পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি প্রতিষ্ঠাকে বাধাগ্রস্ত করবে।
ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন কংগ্রেস রাশিদা তালিব বলেছেন, তিনি এ চুক্তি উদযাপন করবে না। কারণ এটি ফিলিস্তিনিদের কোনো উপকার করবে না। বলেন, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ধ্বংসাত্মক আচরণ করা হচ্ছে। এটিই এখন মূল প্রধান বিষয়। বলেন ট্রাম্প-নেতানিয়াহু চুক্তি ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়। বরং ইসরাইলের সঙ্গে আরো দেশকে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সহায়তা করবে।
২০২০ সালের শুরুতে ট্রাম্প এবং কুশনার ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে তথাকথিত ডিল অব সেঞ্চুরির নকশা প্রণয়ন করেন। যাতে পশ্চিম তীরসহ ফিলিস্তিনের ভূমিতে বসতি স্থাপন করা এলাকাগুলোকে নিজেদের ভূখণ্ডের সঙ্গে একীভূত করতে ইসরাইলকে ক্ষমতা দেয়া হয়। যদিও বিবদমান পক্ষগুলোকে রাজি করাতে না পারায় ট্রাম্প-কুশনারের সে প্রকল্প এখন স্থবির হয়ে আছে।
লেখক: মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ। সূত্র: মিডল ইস্ট আই। ভাষান্তর: ফাইয়াজ আহমেদ