সংস্কৃতি মানুষের আত্মপরিচয়, জীবনবোধ এবং জীবনধারার প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি জাতি বা গোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, ঐতিহ্য আছে। বিশ্বাস ও মূল্যবোধ আছে, যেখানে মানুষ তার শেকড়ের টান অনুভব করে। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত উৎসব পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ যেন প্রতিটি বাঙালির অস্তিত্বের সাথে নিবিড়ভাবে মিশে আছে। যার বন্ধন সুদৃঢ় এবং অবিচ্ছেদ্য।
নববর্ষে আবহমান গ্রাম বাংলায় যে হালখাতা উৎসবের আমেজ দেখা যায় তা আজ নেই। এবার রাজধানীর বুকেও বর্ষবরণের কোন বর্ণিল আয়োজন নেই। চারপাশে থমথম নিরবতা। বৈশাখী উৎসবের আনন্দ, উচ্ছ্বাস যেন মন থেকে মুছে গেছে। নেই সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের মিলন মেলা। থমকে গেছে পৃথিবী। অবরুদ্ধ মানুষ। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কাটছে সময়। সবার মনেই যেন করোনা ভাইরাস এক অজানা আতঙ্ক। রাজপথে নেই চারুশিল্পীদের বর্ণাঢ্য মঙ্গলশোভা যাত্রা। নেই দেয়ালে দেয়ালে নানান রঙ বেরঙের চিত্রকর্মের প্রদর্শনী। কোন মঞ্চে আবৃত্তি শিল্পীদের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের কবিতা হয়নি পাঠ। শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ, টি.এস.সি এবং চারুকলাসহ সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা যেন নিরবতায় থমকে গেছে।
এবার নববর্ষের প্রথম প্রভাতে রমনা উদ্যান ছিল জনশূন্য। ছিল না ছায়ানটের কোন উদ্যোগ। পাখির কলকাকলি আর প্রকৃতির পাতাঝরা শব্দ শোনা যায়। চারপাশে মানুষের কোন কোলাহল নেই। এবার রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’-এর মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়নি। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুলতলার প্রভাতী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। কবিতা, গান আর নৃত্যের মাধ্যমে নববর্ষকে সম্ভাষণ জানানো হয়নি। প্রিয়জনদের সাথে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় যেন মুঠোফোন আর ফেইসবুকেই সীমাবদ্ধ।
পুরনো গ্লানি আর জরা জীর্ণতাকে মুছে দিয়ে নিসর্গের ক্যানভাসে প্রিয়জনের হাতে হাত রেখে আবেগ আর অনুরাগে হারিয়ে যেতে চেয়েছিল বাঙালি। পারেনি গাছের শ্যামল ছায়ায় দাঁড়িয়ে প্রিয় মানুষটির সাথে ভালবাসার কথা বলতে। সমুদ্র সৈকতেও যেন সুনসান নিরবতা। পাহাড়ি জনপদও যেন শান্ত। আকাশেও নেই কোন মেঘের গর্জন। নেই মেঘ আর বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা।
এবার প্রকৃতির কোলে মাটির সানকিভরা পান্তা ভাতে ইলিশ ভাজা খেতে পারেনি বাঙালি। লাল কৃষ্ণচূড়ার আগুনরাঙ্গা সকাল আর বৈশাখীর রঙে রাঙিয়ে যাওয়া ব্যস্ত দূপুর যেন হারিয়ে গেছে করোনার ভয়াল থাবায়। মানুষ গৃহবন্দি। প্রান্তিক মানুষের স্বপ্নে আগামীর দিনগুলি যেন মেঘাচ্ছন্ন। অনিশ্চিত, গন্তব্যহীন।
আমরা কি সেইসব প্রান্তিক কর্মহীন অসহায় মানুষের পাশে ভালবেসে দাঁড়াতে পারি না? এমন সংকট সময়ে আজ না হোক বর্ষবরণ। কালতো হবে। এমন আঁধার কেটে আলোর পথে বিশাল জনস্রোতে একদিন আমাদের মিছিলে হবে দেখা। আমাদের দেখা হবে আবার প্রাণের উৎসবে। দেখা হবে দুচোখ ভরে ঘর থেকে বাইরে। আবার পুতুল নাচে ভরে উঠবে আমাদের শিশুদের মন। আবার নাগরদোলায় চরে আমাদের শিশুরা উল্লাসে মেতে উঠবে।
আজ বৈশাখের এমন দিনে মনে পড়ে যাই রবীন্দ্রনাথের সেই গান -
সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি ....
লেখক: সুজন হাজং, গীতিকার
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। সময় সংবাদের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতে পারে। লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় সময় সংবাদ নেবে না।