খুলনার কয়রা উপজেলায় ছাত্রলীগ সভাপতির বিরুদ্ধে ছাত্রদলের ‘বি-টিম’ হিসেবে কাজ করার অভিযোগ উঠেছে। ছাত্রদলের আহ্বায়কের শ্যালক ছাত্রলীগ না করেও দলের উপজেলা কমিটির সভাপতি পদ পায়। এর পর থেকে ছাত্রদল কর্তৃক ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা।
সব শেষ রোববার সন্ধ্যায় শ্যালক ছাত্রলীগ সভাপতির সম্মতিতে দুলাভাই ছাত্রদল আহ্বায়কের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। এতে ছাত্রলীগের ইউনিয়ন সভাপতিসহ চার নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। গুরুতর আহত অবস্থায় একজনকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আহতরা সোমবার (১৫ জুলাই) দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এসব অভিযোগ করেছেন। হামলার ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলে ওসি মামলা নেননি বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।
হামলার শিকার ছাত্রলীগ নেতা হাফিজুল ইসলাম জানান, সন্ধ্যায় তারা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের অস্থায়ী কার্যালয়ে বসে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। এসময় উপজেলা ছাত্রলীগের নব্য সভাপতি শরিফুল ইসলাম টিংকুর দুলাভাই কয়রা থানা ছাত্রদলের আহবায়ক আবুল কালাম আজাদ কাজলের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়।
হামলায় উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের ছাত্রলীগ সভাপতি আশিকুজ্জামান রাহাত, যুগ্ম-সম্মাদক শাহিন, সদস্য ইমরান ও যুবলীগ নেতা হাফিজুল ইসলাম আহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় আশিকুজ্জামান রাহাতকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
রাহাত বলেন, ঘটনার পরপরই বিষয়টি নিয়ে থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। হামলায় ছাত্রলীগের কার্যালয়টিতেও ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয় বলে তিনি অভিযোগ করেন।
লিখিত বক্তব্যে নির্যাতিতরা বলেন, কয়রায় বিএনপির কতিপয় সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের মুখোশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। কয়রা উত্তর বেতকাশী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি সরদার মতিউর রহমানের ছেলে কয়রা থানা ছাত্রদলের আহবায়ক আবুল কালাম আজাদ এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারই শ্যালক হলেন ছাত্রলীগ কয়রা থানার নব্য সভাপতি শরিফুল ইসলাম টিংকু। ফলে আত্মীয়স্বজন মিলে বিএনপি ও ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করছে। এলাকার নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার নির্যাতন করেই চলেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০০১ সালের ৬ অক্টোবর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি সরদার মতিউর রহমানের নেতৃত্বে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা বাবু বিধান চন্দ্র অধিকারী ও শিপপদ অধিকারীর ওপরও এমন হামলা ও নির্যাতন চালায়। এখন তারই পুত্র নিজ শ্যালককে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর করে অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে, সংবাদ সম্মেলনের পর শরীফুল ইসলাম টিংকুর সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেছে। ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজায়ানুল হক চৌধুরী শোভনের সঙ্গে তোলা সেলফি দেখিয়ে চাঁদাবাজি, বিদেশ পাঠানোর নামে বিভিন্ন ব্যক্তির থেকে প্রায় ৮৬ লাখ টাকা লোপাট, ছাত্র না হয়েও ছাত্রলীগে পদ পাওয়া, পরিবার ও আত্মীয়দের মধ্যে সবাই বিএনপি-জামাতের রাজনীতি করা ও কমিটি হওয়ার মাত্র ৪ দিনের মাথায় হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, গত ২৪ জুন টিংকুকে সভাপতি করে ৫ সদস্যের থানা কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এর মাত্র ২২ দিন আগে নিয়ম অনুযায়ী সেখানে ছাত্রলীগের কমিটি দিয়েছিল খুলনা জেলা ছাত্রলীগ। কিন্তু ব্যাপক বিতর্কিত, এলাকায় বহু মানুষের অর্থ আত্মসাৎ, বিএনপি-জামাত সংশ্লিষ্ঠতার কারণে সেই কমিটিতে স্থান পায়নি টিংকু।
পরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে তার অর্থ লেনদেন ও সখ্যতার বলে এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতার সরাসরি সুপারিশে সদ্য কমিটি ভেঙে দিয়ে টিংকুকে দিয়ে নতুন কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
সেলফি দেখিয়ে চাঁদাবাজি:
ওই কমিটি ঘোষণার মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে অন্তত ১০ জনের কাছে টিংকু চাঁদা দাবি করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে ভুক্তভোগীরা ভিটে ছাড়া হওয়ার ভয়ে নিজেদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
মাত্র ১৫ দিনেই বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের ফলে স্থানীয় থানায় তার সমর্থকদের নাম উল্লেখ করে ৮টি জিডি হয়েছে। চাঁদা দাবির সময় টিংকু কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতির সঙ্গে তার তোলা একটি সেলফি দেখিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, টিংকু ওই ছবি দেখিয়ে বলেন, কেন্দ্র থেকে আমাকে পদ দিয়েছে তাদের টাকা দিতে হচ্ছে। এজন্য আপনাদের টাকা দিতে হবে।
এর আগে এলাকার বিভিন্ন মানুষের থেকে তিনি প্রায় ৮৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কমিটিতে আসার কয়েক দিন আগেও তার বিরুদ্ধে খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ভুক্তভোগীরা তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরেন।
এর মধ্যে টিংকুর নিজ গ্রামের ইউনুস সরদার ৬ লাখ টাকা, সাহেব আলী ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা, কলেজ শিক্ষীকা আফসানা আক্তার ৫০ হাজার টাকা, বিল্লাল ৭০ হাজার টাকা, টুকু (বতুল বাজার গ্রাম) ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা, ইয়াছিন ইসলাম (বয়রা, খুলনা) ৮ লাখ টাকা, তামিম (মোড়লগঞ্জ) ৪ লাখ টাকা ও বাবলুর ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা অন্যতম।এদের কেউ কেউ সরাসরি টিংকুর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিয়েছেন যার রশিদও রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, টিংকুর কাছে টাকা ফেরত চাইলে তিনি বলেন, টাকা ভাইকে দিয়েছি (কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতিকে)। ভাই সময় মতো আপনার কাজ করে দেবেন। এটা নিয়ে যদি বাড়াবাড়ি করেন তাহলে আমি ভাইকে জানালে কিন্তু আপনারা বিপদে পড়বেন। জামাত-বিএনপির মামলায় ফেঁসে যাবেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, টিংকু নানা সময়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতির সঙ্গে তার ছবি দেখিয়ে বিভিন্ন রকম ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গেও তার তোলা সেলফি দেখিয়ে ভয় দেখান বলে সংবাদ সম্মেলনে তারা অভিযোগ করেন।
তবে টিংকুকে ছাত্রলীগের সভাপতি করে কমিটি ঘোষণার পর থেকেই ওইসব ব্যক্তিরা আর টাকা চাইতে বা কারো কাছে নালিশ করতে সাহস পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্তত ৫ জন স্থানীয় সাংসদ ও জেলা আওয়ালী লীগের নেতাদের কাছে ইতিপূর্বে বিচার দিয়েছেন।
অছাত্র হয়েও ছাত্রলীগ সভাপতি:
জানা যায়, টিংকুর বর্তমানে ছাত্রত্ব নেই। প্রায় ৮ বছর আগে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়া যান। কিন্তু সেখানে পড়ালেখা না করে আদম ব্যবসা শুরু করেন। ঢাকার ফার্মগেটে ও খুলনাতে অফিস নিয়ে মানব পাচারের ব্যবসা খুলে বসেন তিনি।
টিংকু বাংলাদেশ কংগ্রেস নামে একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র কংগ্রেসের মালয়েশিয়া শাখার আহ্বায়ক ছিলেন। নিজের ওই পদ উল্লেখ করে বাংলাদেশে পোস্টার চাপিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি ছাত্রলীগ সভাপতি হওয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এজন্য কয়রা থানার ৫টি ইউনিয়নের আওয়ামী পন্থী চেয়ারম্যানরা তার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছে।
বিএনপি-জামাত সংশ্লিষ্টতা:
টিংকুর একমাত্র বোনের জামাই মো. আবুল কালাম আজাদ (কাজল) বর্তমানে ছাত্রদলের কয়রা থানা আহ্বায়ক। একই সঙ্গে তিনি সরকারবিরোধী আন্দোলনে গাড়ি ভাঙচুর ও বিস্ফোরক দ্রব্য সংক্রান্ত অন্তত চারটি মামলার আসামি। এসব মামলায় তার বিরুদ্ধে চার্জশিটও হয়েছে।
অন্যদিকে টিংকুর বোনের শশুর সরদার মতিয়ার রহমান কয়রার উত্তরবেদকাশী ইউনিয়ন (টিংকুর ইউনিয়ন) বিএনপির আহ্বায়ক। তিনি বিএনপি থেকে একাধিকবার চেয়ারম্যান ছিলেন।
টিংকুর আপন মামা মো. নুরুল ইসলাম খোকা স্বেচ্ছাসেবক দলের কয়রা উপজেলা শাখা আহ্বায়ক। খোকার বিরুদ্ধেও সরকার বিরোধী আন্দোলনের ভাঙচুর ও বিস্ফোরক সংক্রান্ত আইনে একাধিক মামলা রয়েছে।
এছাড়া টিংকুর ৫ চাচার মধ্যে ৪ জন সরাসরি জামাতের কর্মী। তার পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনের কেউ কোনো দিন আওয়ামী লীগের বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতি করেনি। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছেন।
স্থানীয়দের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টিংকুর দুলাভাই কাজল সরকার বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় এবং একাধিক মামলার আসাসি হওয়ায় রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। দুলাভাই তার শ্যালককে গত নির্বাচনের আগে মালয়েশিয়া থেকে দেশে এনে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করান। তাকে ছাত্রলীগে প্রতিষ্ঠিত করতে যাবতীয় অর্থ ও বুদ্ধি-পরামর্শ দেন কাজল। মূলত দুলভাই, মামা ও চাচাদের রক্ষা করতে টিংকু ছাত্র না হয়েও ছাত্রলীগ করা শুরু করেন। বিষয়গুলো স্থানীয় নেতারা জানার কারণে সে সুবিধা করতে না পেরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কয়েকজনকে সঙ্গ দিয়ে মন জয় করেন। ফলে জেলা থেকে কমিটিতে পদ না পেলেও সরাসরি কেন্দ্র থেকে থানার কমিটি করিয়ে নেন। যা ছাত্রলীগের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।
এ বিষয়ে খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পারভেজ হাওলাদার ও সম্পাদক ইমরান হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা টিংকুর বিষয়ে কোনো কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে টিংকুকে ফোন করা হলে তার ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে জানতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজায়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে তার মোবাইল নম্বরে মেসেজ পাঠালেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।